আতশবাজি ও ফানুস

 আতশবাজি ও ফানুস : ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ,চিরস্থায়ী ক্ষতি

প্রতিবছর নগরবাসী, বিশেষ করে শিশু-কিশোর-তরুণরা ৩১ ডিসেম্বর রাতে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানোর মাধ্যমে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লক্ষ করা গেছে- নববর্ষ উদযাপনে ব্যাপকভাবে আতশবাজি, পটকা, ফানুস প্রভৃতির ব্যবহার হয়-যা মানুষ, পরিবেশ ও প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতি করছে। ফানুস ওড়ানোর ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় দুর্ঘটনাও ঘটে। ফলে আনন্দঘন এ রাত কখনো কখনো বিষাদে পরিণত হয়। ভয়াবহ শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রোগী, বৃদ্ধ, শিশু ও পাখি।

আতশবাজি কে না বলুন


বস্তুত ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টার পর থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের আকাশে আলোর ঝলকানি শুরু হয়। রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজির বর্ণিল আলোয় আলোকিত হয় আকাশ। তবে মুহুর্মুহু কান ফাটানো শব্দে বিরক্ত হয় বাসাবাড়ির বাসিন্দারা। নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকাসহ সারা দেশে ফানুস ওড়ানো এবং আতশবাজি না পোড়ানোর ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেয় পুলিশ। কিন্তু সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে উৎসবে মেতে ওঠে অনেকে। নতুন বর্ষবরণের নামে একশ্রেণির মানুষের এমন কর্মকাণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন সচেতন নগরবাসী। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় বলে মনে হয় না।

আমরা জানি, ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ হলো শব্দদূষণ। রাতে ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি ও পটকা পোড়ানোর আনন্দ-উল্লাস অনেকের জন্য বিপদ ডেকে আনে। এতে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ বড় শহরের বায়ু ও শব্দদূষণ তীব্র হয়ে ওঠে। অসুস্থ ব্যক্তি, শিশু ও প্রবীণ মানুষ অস্বস্তি ও অসুস্থবোধ করেন। বিশেষ করে যারা হার্টের রোগী, তাদের জন্য এ বিকট শব্দ মারাত্মক ক্ষতির, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, খিটখিটে মেজাজ, মাথাব্যথা, পেপটিক আলসার, অস্থিরতা, অমনোযোগী ভাব সৃষ্টি হতে পারে; হ্রাস পেতে পারে শ্রবণশক্তি ও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা। উচ্চশব্দ মানুষের ঘুমেরও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

এদেশে বহুকাল ধরেই বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনে আতশবাজি ব্যবহার হয়ে আসছে। আতশবাজি খেলার মাধ্যমে উৎসব উদযাপন অনেকের আনন্দের খোরাক হলেও প্রাণীদের জন্য তা আতঙ্কের। আতশবাজিতে উচ্চমাত্রায় শব্দ ও বায়ুদূষণ হয়, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় শহরের পাখিগুলো। এ প্রচণ্ড শব্দে পাখিগুলো ওড়াওড়ি করে এবং গাছে বা বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে আঘাত পেয়ে নিচে পড়ে গিয়ে আহত হয়, এমনকি মারাও যায়। বস্তুত উচ্চ শব্দদূষণের কারণে নগরীর প্রাণিকুল বিলুপ্তির পথে, বিশেষত পাখিশূন্য হচ্ছে শহর। এর আগে বর্ষবরণের রাতের বিকট শব্দ ও বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন জায়গায় পাখির মৃত্যু হয়েছে। পাখি ভয় ও আতঙ্কে বাসা থেকে উড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। অনেক পাখি অসুস্থ হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে চড়ুইসহ ছোট পাখির। আর বিকট শব্দে পালিয়ে যায় টিয়া, কাক, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, দোয়েল ও শালিক পাখি।

উৎসব মানেই কি পাখির মৃত্যু


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক বাড়িতে ও শোবার ঘরে শব্দের মাত্রা ২৫ ডেসিবল, অন্যান্য রুমে ৪০ ডেসিবল, হাসপাতালে ২০ থেকে ৩০ ডেসিবল, রেস্টুরেন্টে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল, অফিস কক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ ডেসিবল এবং শ্রেণিকক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল থাকা স্বাস্থ্যসম্মত। এর চেয়ে বেশি হলে সেটা শব্দদূষণের পর্যায়ে পড়ে। স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা এর বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।

ফানুস মূলত ছোট আকারের একটি হট এয়ার বেলুনের মতো কাজ করে। ফানুসে থাকা মোমবাতি একে বাতাসে উড়তে সাহায্য করে। ওজনে হালকা হওয়ায় আগুন না নেভা পর্যন্ত বেশ উঁচুতেই উড়তে পারে ফানুস। জানা যায়, একটি ফানুস ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় ৬ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত উড়তে পারে। ফানুসের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহার করা হয় তার ও বাঁশের ফ্রেম। আকাশে উড়তে থাকা অনেক পাখিরই ফানুসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মৃত্যু ঘটে। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফানুসের আগুন নিভে যায় না। ফলে এ ফানুস গাছপালা বা মাটিতে থাকা দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

উৎসবের অনুষঙ্গ আতশবাজি পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬.৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩.৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩.৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম এবং ৬.২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আতশবাজিতে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের অনুপাত আরও বেশি।

সব মিলিয়ে বলা যায়, পটকা ও আতশবাজি মূলত তিন ধরনের ক্ষতি করে। এগুলো পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়, যা চারদিকে শব্দদূষণ ঘটায়। এ শব্দ শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে। আতশবাজির শব্দে প্রাণীরা চমকে ওঠে। এ কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার পাখি ও বন্যপ্রাণী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। পথে থাকা কুকুর-বিড়াল ভয়ে ছোটাছুটি করে, আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া এ থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটায়, যা ফুসফুসের নানা রোগের কারণ হতে পারে। তাই আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানো বন্ধে সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

Post a Comment

Previous Post Next Post